মাওলানা হাফিজ মারজান আহমদ চৌধুরী (ফুলতলী)
আজ সকাল থেকে আমরা, সিলেটের বাসিন্দারা লাগাতার ভূমিকম্প অনুভব করছি। মানুষ আতঙ্কিত। অনেকে প্রশ্ন করছেন, এসব ছোট ছোট ভূমিকম্প কি বড় ভূমিকম্পের পূর্বলক্ষণ? ভূমিকম্পে আমাদের করণীয় কী? প্রশ্নগুলোর জবাব জানার জন্য আমি দুটি সূত্রের দ্বারস্থ হয়েছিলাম— একটি বিজ্ঞান, যেটি ভূমিকম্পের জাগতিক কারণ ও পদ্ধতি ব্যাখ্যা করা করবে। আরেকটি কুরআন ও সুন্নাহ, যেখানে এর প্রকৃত কারণ ও করণীয় খুঁজে পাব। এ দুটি সূত্র থেকে আপনাদের জন্য কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য পেশ করছি।
ভূমিকম্প কীভাবে হয়, সেটি আমরা জানি। ১৯১২ সালে জার্মান বিজ্ঞানী আলফ্রেড ওয়েগনার আবিষ্কার করেছেন, পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ অনেকগুলো খণ্ডে বিভক্ত। এই খণ্ডগুলোকে টেকটনিক প্লেইট বলা হয়। এগুলো একে অপরের পাশাপাশি, কিন্তু স্থির নয়। তাই কখনো এদের মাঝে সংঘর্ষ হয়। বিপুল পরিমাণে শক্তি বহন করা দুটি টেকটনিক প্লেইট যখন একে অপরের সাথে ধাক্কা খায় তখন তলদেশে জমাট শক্তি বাইরে নির্গত হয়, যা পৃথিবীর উপরিভাগকে কাঁপিয়ে দেয়। তখন পৃথিবীতে ভূমিকম্প অনুভূত হয়।
স্বাভাবিকভাবে প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের জাগতিক কারণ ও পদ্ধতি রয়েছে। তবে সেই ‘কারণ’ তখনই কার্যকরী হয়, যখন আল্লাহ এগুলোকে নির্দেশ দেন। ভূমিকম্পও এর ব্যতিক্রম নয়। আল্লাহ বলেছেনঃ
إِذَا زُلْزِلَتِ الْأَرْضُ زِلْزَالَهَا وَأَخْرَجَتِ الْأَرْضُ أَثْقَالَهَا وَقَالَ الْإِنْسَانُ مَا لَهَا يَوْمَئِذٍ تُحَدِّثُ أَخْبَارَهَا بِأَنَّ رَبَّكَ أَوْحَى لَهَا
“যখন যমিন প্রচণ্ডভাবে প্রকম্পিত করা হবে। এবং পৃথিবী তার ভূগর্ভস্থ বোঝা বাইরে নিক্ষেপ করবে। মানুষ বলবে, এর কী হয়েছে? সেদিন যমিন তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে। কারণ তোমার রব তাকে আদেশ করবেন।” [সুরা যিলযাল : ১-৫]
ভূমিকম্পসহ যাবতীয় প্রাকৃতিক বিষয়কে আল্লাহ তাঁর ‘আয়াত’ বা নিদর্শন হিসেবে তৈরি করেছেন। আল্লাহ বলেছেনঃ
وَفِي الْأَرْضِ آيَاتٌ لِّلْمُوقِنِينَ
“দৃঢ় বিশ্বাসীদের জন্য যমিনে অনেক নিদর্শন রয়েছে।” [সুরা যারিয়াত : ২০]
আল্লাহ এসব ‘আয়াত’ বা নিদর্শন প্রকাশ করার মাধ্যমে আমাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করেন, যেন আমরা আমাদের রবকে ভুলে না যাই। আল্লাহ বলেছেনঃ
وَمَا نُرْسِلُ بِالْآيَاتِ إِلَّا تَخْوِيفًا
“আমি কেবল ভীতি প্রদর্শনের জন্যই (আযাবের) নিদর্শনসমূহ পাঠাই।” [সুরা ইসরা : ৫৯]
আবার কখনো ভূমিকম্প আমাদের জন্য আযাব হিসেবেও সমাগত হয়। আবু মূসা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
أُمَّتِي هَذِهِ أُمَّةٌ مَرْحُومَةٌ لَيْسَ عَلَيْهَا عَذَابٌ فِي الآخِرَةِ عَذَابُهَا فِي الدُّنْيَا الْفِتَنُ وَالزَّلاَزِلُ وَالْقَتْلُ
“আমার এই উম্মাত দয়াপ্রাপ্ত উম্মাত। এই উম্মাতকে আখিরাতে কোনো আযাব দেয়া হবে না। তবে দুনিয়াতে এদের শাস্তি হলো ফিতনা, ভূমিকম্প ও যুদ্ধবিগ্রহ।” [সুনান আবি দাউদ; কিতাবুল ফিতান ওয়াল-মালাহীম]
এবার প্রশ্ন আসে, ছোট ছোট ভূমিকম্প কি বড় ভূমিকম্পের পূর্বলক্ষণ? আমেরিকার Seismology Lab (জানুয়ারি ২০১৯) জানিয়েছে, ভূমিকম্পের ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়। কখনো বড় ভূমিকম্পের পূর্বে ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়, কখনো হয় না। আবার কখনো পরপর অনেকগুলো ছোট ভূমিকম্প হলেও বড় ভূমিকম্প হয় না। অপরদিকে আমেরিকার ভূবিজ্ঞান ও মহাকাশ গবেষণা সংস্থা AGU এর একটি গবেষণাপত্রে (জুলাই ২০১৯) বলা হয়েছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছোট ছোট ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের পূর্বলক্ষণ। মোটকথা, আমরা নিশ্চিতভাবে কিছু জানি না। আর জেনেও যে কিছু করে ফেলতে পারব, এমনটিও নয়। ভূবিজ্ঞানীদের মতে, আমাদের সিলেট অঞ্চল অনেক বছর ধরে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। অতীতেও এ অঞ্চলে তিনটি শক্তিশালী ভূমিকম্প (১৮৬৯, ১৯১৮, ১৯২৩) হয়েছিল। হয়তো কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করার মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমবেশি হতে পারে। কিন্তু ভূমিকম্প এমন এক দুর্যোগ, যা পূর্বানুমান করা যায় না, যাকে থামানো যায় না, যাকে মোকাবিলা করার শক্তি মানুষের নেই। ভূমিকম্পের সময় করণীয় বলে যা কিছু শেখানো হয়, ভূমিকম্পের প্রথম ধাক্কায় মানুষ তা ভুলে যায়। পায়ের তলার মাটি যখন দুলছে, তখন কার মগজ বিজ্ঞান নিয়ে পড়ে থাকবে বলুন?
আরেকটি বিষয় ভুলে গেলে চলবে না যে, অধিক ভূমিকম্প কিয়ামাতের সুস্পষ্ট আলামত। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
لاَ تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يُقْبَضَ الْعِلْمُ وَتَكْثُرَ الزَّلاَزِلُ وَيَتَقَارَبَ الزَّمَانُ وَتَظْهَرَ الْفِتَنُ وَيَكْثُرَ الْهَرْجُ وَهْوَ الْقَتْلُ الْقَتْلُ حَتَّى يَكْثُرَ فِيكُمُ الْمَالُ فَيَفِيضُ
“কিয়ামাত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না (দ্বীনি) ইলম উঠিয়ে নেয়া হবে, অধিক পরিমাণে ভূমিকম্প হবে, সময় সংকোচিত (দ্রুত) হয়ে আসবে, ফিতনা প্রকাশিত হবে, হারাজ তথা যুদ্ধবিগ্রহ বৃদ্ধি পাবে। এমনকি তোমাদের সম্পদ এত বৃদ্ধি পাবে যে, তা উপচে পড়বে।” [সহীহ বুখারী; কিতাবুল ইস্তিসক্বা]
বর্তমান পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করুন, এই আলামতসমূহের মধ্যে একটিও কি প্রকাশিত হওয়ার বাকি আছে? জবাব হবে, না। অতএব আমাদেরকে কিয়ামাতের প্রলয়ঙ্করী ঝাঁকুনির জন্য প্রস্তুত হওয়া উচিৎ। আল্লাহ বলেছেনঃ
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمْ إِنَّ زَلْزَلَةَ السَّاعَةِ شَيْءٌ عَظِيمٌ
“হে মানবজাতি, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় করো। নিশ্চয়ই কিয়ামাতের প্রকম্পন এক ভয়ানক ব্যাপার।” [সুরা হাজ্জ : ১]
শেষ প্রশ্নটি হচ্ছে, ভূমিকম্প হলে আমাদের করণীয় কী? প্রথমত, সম্ভব হলে ঘর ছেড়ে খোলা জায়গায় চলে যাওয়া, আর না হলে শক্ত কিছুর নিচে নিজেকে সুরক্ষা করা। ভূমিকম্পের সময় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইন বন্ধ করে দেয়া। তবে আসল জবাব হচ্ছে, রবের দিকে মুখ ফেরানো। ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
إِذَا رَأَيْتُمْ آيَةً فَاسْجُدُوا
“যখন তোমরা আল্লাহর আয়াত বা নিদর্শন দেখবে, তখন সাজদায় পতিত হবে।” [সুনান আবি দাউদ; কিতাবুল ইস্তিসক্বা]
আবু মূসা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
فَإِذَا رَأَيْتُمْ شَيْئًا مِنْ ذَلِكَ فَافْزَعُوا إِلَى ذِكْرِهِ وَدُعَائِهِ وَاسْتِغْفَارِهِ
“যখন এরকম কোনো (আয়াত বা নিদর্শন) দেখ
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাউছার উদ্দিন সুমন
নির্বাহী সম্পাদক: আনিছুর রহমান পলাশ
বার্তা সম্পাদক: শহিদুল ইসলাম রেদুয়ান
সাব এডিটর: আবু তাহের, আফতাব উদ্দিন।