বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:২৯ পূর্বাহ্ন

রাজস্থলীতে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর জীবন জনদুর্ভোগে বিশুদ্ধ পানি সংকট নির্ভর করছে অস্থায়ী কুয়ায়

হাওড় বার্তা ডেস্ক
  • সংবাদ প্রকাশ শুক্রবার, ১১ জুন, ২০২১
  • ৫২৮ বার পড়া হয়েছে

চাইথোয়াইমং মারমা

রাঙ্গামটি জেলা প্রতিনিধি:

কাপ্তাই খালের ধারে দুই ফুট বাই দুই ফুট অস্থায়ী পানির কুয়া। সেই কুয়াকে ঘিরে সকাল সন্ধ্যা ত্রিপুরা নৃগোষ্ঠীর মানুষের জটলা। কারো হাতে কলস আবার কেউবা এসেছেন প্লাস্টিকের কনটেইনার হাতে। একটু একটু করে কুয়ায় জমা পানি কলসে ভরে নিয়ে যাবেন বাড়ি। দুই-তিন মিনিটে কলস ভরলেও বাড়ি ফিরতে ডিঙোতে হবে পাহাড়। সারাদিন জুম চাষের পর শরীর না চললেও এই পানি বয়ে নিয়ে যেতে হবে। তা নাহলে সারারাত তৃষ্ণায় ছাতি ফাটলেও মিলবে না খাবার পানি।

রাঙ্গামাটির রাজস্থলী উপজেলার ১নং ঘিলাছড়ি ইউনিয়নের ১ এবং ২নং ওয়ার্ডের তেরটি ত্রিপুরা গ্রামের প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের খাবার পানির প্রধান উৎস কাপ্তাই খাল পাড়ের এই অস্থায়ী কুয়া। রান্না-ধোয়া–খাওয়া ত্রিপুরাদের সবকিছুই এই খালের পানির ওপর নির্ভরশীল। যেহেতু খালই একমাত্র পানির উৎস, তাই তা বিশুদ্ধ না দূষিত সেই বিবেচনার সুযোগ নেই। ফলে ডায়রিয়া, কলেরাসহ নানা পানিবাহিত রোগে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর নিত্যসঙ্গী। এসব রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যাও কম নয়। গরম আবহাওয়া ও পাহাড়ী পথে চলা ফেরা এবং জুম চাষে পরিশ্রমের কারণে নিয়মিত পাহাড়ীদের অন্তত ৫/৬ লিটার পানি প্রয়োজন৷ কিন্তু সহজপ্রাপ্য না হওয়ায় পাহাড়ের মানুষেরা প্রয়োজনের চেয়ে কম পানি পান করেন। এতে করে কিডনী রোগেও আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে।

বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা। কিছু সময় পরেই সূর্য তার তেজ কমিয়ে ওই দূরের সবুজে ঘেরা পাহাড়ে লুটিয়ে পড়বে। কাপ্তাই পাড়ে পানি নিতে আসা হাঁলুংতি ত্রিপুরা কাছের মিতিঙ্গাছড়ি পাড়ার বাসিন্দা। বয়স পঞ্চাশের এদিক ওদিক হবে খানিকটা। তার পরিবারের খাবার পানির একমাত্র অবলম্বন এই কুয়া। মিনিট দশেক অপেক্ষার পর আসে তার পানি নেয়ার পালা। পেছনে দাঁড়িয়ে আছে আরো নয়জন, সবাই এসেছে পানি নিতে। কুয়া থেকে এক কলসি পানি ভরতে না ভরতেই পানি শুকিয়ে যায়। তারপর আরও মিনিট পাঁচেকের জন্য অপেক্ষা, কখন আবার কুয়ায় পানি ভরে উঠবে।

এক কলসি পানি ভরানোর বেশ কিছুক্ষণ পর আবার আরেক কলসিতে পানি ভরলেন হাঁলুংতি। এভাবে প্রায় আধঘন্টা অপেক্ষার পর দুই কলসী কাঁধে করে উঠে আসলেন তিনি। এগিয়ে যেতেই ত্রিপুরা ভাষায় বললেন, ‘ব তৈ মুংহা খা্ওচৈখে খা্ওচৈমসে’। বাংলায় যার অর্থ দাড়ায়, “এখানে পানির অনেক কষ্ট। তিনি জানালেন, ঘরের খাবার পানি হিসেবে ব্যবহার করতেই নিয়ে যাচ্ছেন। সারাদিন জুম পাহাড়ে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর তার চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট লেগে আছে। টিউবওয়েল বা রিংওয়েল থেকে পানি সংগ্রহ না করে খালের কুয়া থেকে খাবার পানি সংগ্রহের কারণ জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, “গ্রামে তো কোনো টিউবওয়েল বা রিংওয়েল নাই!” বছরখানেক আগে একটি রিংওয়েল খোঁড়া হয়েছিল, সেটি খোঁড়ার মাসখানেক পরে নষ্ট হয়ে গেছে। তাই বাধ্য হয়েই তারা খাল থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করছেন।

উপজেলা সদর হতে স্হানভেদে এলাকার গ্রামগুলো ১০ থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে। তারমধ্যে সব থেকে কাছের গ্রাম নতুন পাড়া আর সবথেকে দূরের ভূটান পাড়া। যুগ যুগ ধরে বংশ পরম্পরায় বাস করে আসা এই এলাকাটিতে একেবারেই উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি বলে এলাকাবাসীর আক্ষেপ। সদর উপজেলা থেকে দুর্গম এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না হওয়ায় এখনো উন্নয়নের মুখ দেখেনি এই এলাকার মানুষ। আর্থ-সামাজিক থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সবদিক থেকে পিছিয়ে এলাকাটি। একটি স্বাধীন সার্বভোম রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে মানুষের যে মৌলিক চাহিদাগুলো রয়েছে, তা তাদের কাছে কেবলই শুধু সংবিধানের পাতায় সীমাবদ্ধ।

জবিহাঁ ত্রিপুরা (৫০) থাকেন ১নং ঘিলাছড়ি ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের মিতিঙ্গাছড়ি পাড়ায়। চার বছর আগে ডায়রিয়ায় ২০ বছর বয়সী মেয়ে বাওয়াইতি ত্রিপুরাকে হারিয়েছেন তিনি। এখনো সন্তান হারানোর কষ্ট বুকে চেপে বয়ে বেড়াচ্ছেন। দাওয়ায় বসে কথা হয় তার সাথে। আক্ষেপ করে বলেন, “বিশুদ্ধ পানির অভাবে চার বছর আগে আমি আমার এক কন্যাকে হারিয়েছিলাম। মারা যাবার সময় তার কোলে ১ মাস বয়সের শিশু সন্তান ছিল। সন্তান হারানোর কষ্ট যে কি, তা যার গেছে সেই বুঝে।”

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিকট বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থার জন্য কোনও আবেদন করা হয়েছিল কিনা এমনটা জানতে চাইলে তিনি আরও জানান, “দুই বছর আগে সরকার থেকে একটা রিংওয়েলের বরাদ্দ এসেছিল। কিন্তু যে কন্ট্রাক্টর টেন্ডারটি পায় তিনি সদর থেকে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না হওয়াসহ বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে ৫-৭ ফুট পর্যন্ত খুঁড়ে কোনোরকম বসিয়ে চলে যায়। এখন সেটি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে।”

মিতিঙ্গাছড়ি পাড়া থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মিতিঙ্গাছড়ি আগা পাড়া। এখানে বাস করা পরিবারের সংখ্যা ২০। সেখানেও একই চিত্র৷ সরকারি বা বেসরকারি কোনও সংস্থার পা-ই পড়েনি সেখানে। এই পাড়ার বাসিন্দা মধুমালা ত্রিপুরা বলেন, পাড়ায় আজ পর্যন্ত কোনও একটা টিউবওয়েল বসেনি! ছড়ার পানিই তাদের ভরসা। বিশেষ করে বর্ষার মৌসুমে যখন পাহাড় থেকে পানির ঢল নামে তখন তাদের কষ্টের সীমা আর থাকে না! অপেক্ষায় থাকতে হয় কখন পানির ঢল কমে গিয়ে পরিষ্কার পানি পাবেন সে আশায়! তাছাড়াও মার্চ-এপ্রিল মাসে যখন পানি শুকিয়ে যায় আর বনের গাছের পাতা ঝরে পানিতে ছড়িয়ে পড়ে, পঁচে বিষাক্ত হয়ে যায় সেই পানি। বিষাক্ত সেই পানি খেয়ে প্রায়ই পাড়ার সবার পেটে পীড়া দেখা দেয়।

কাপ্তাই খালের পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা তেরটির ত্রিপুরা গ্রামের চিত্র প্রায় একই। যেখানকার ১৩টি পাড়া মিলে জনসংখ্যা আনুমানিক প্রায় পাঁচ হাজার। তাদের সবার অভিযোগ, শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে সরকার এলাকাবাসীর স্বাস্থ্যের সুরক্ষার কথা চিন্তা করছে না ফলে আমরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। এলাকাবাসী আরও জানান, ‘আবার সরকার যদি কিছু বরাদ্দ দেয়ও তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঠিক তদারকির অভাবে নিম্নমানের কাজ করে পার পেয়ে যাবে অসাধু চক্রটি। তাতে কিছু সংখ্যক লোক লাভবান হয় ঠিকই কিন্তু তা এলাকাবাসীর উপকারে বয়ে আনে না। এ বিষয়ে ১ নং ঘিলাছড়ি ইউপি চেয়ারম্যান ( ভারপ্রাপ্ত) স্বরসতি ত্রিপুরা জানান, বিষয় টি নজরে এনেছি এল জি এস পির বরাদ্ধ হতে ব্যবস্থা করা হবে।

সর্বশেষ সংবাদ পেতে চোখ রাখুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সব ধরনের সংবাদ
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধনকৃত পত্রিকা। © All rights reserved © 2018-2024 Haworbarta.com
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD
jphostbd-2281