হাওড় বার্তা
স্মৃতিতে অমলিন বুরাইয়ার হুজুর
হযরত মাওলানা আব্দুল কাদির (রহ.)
-মুজতবা হাসান চৌধুরী নুমান ফুলতলী
হযরত মাওলানা আব্দুল কাদির বুরাইয়ার হুজুর (রহ.) কে গত বছরের ১লা সেপ্টেম্বর চির বিদায় দিয়ে এলাম। স্নেহময় একটি মুখ চিরতরে আমরা হারালাম। শেষবারের মতো হুজুরের চেহারা যখন দেখলাম মনে হলো হুজুর এইমাত্র আগের মতো হেসে উঠে স্নেহময় কন্ঠে কুশলাদী জিজ্ঞেস করবেন কিন্তু হুজুর আজ নীরব। যাকে কোনদিন আগে সালাম দেওয়া যেতো না সেই হুজুরের আজকের নীরবতায় আমার মতো পাষাণের হৃদয় গলে অশ্রু বের হয়ে আসলো..
ঝাপসা চোখে আবারো শেষববারের মতো যখন চেহারার দিকে তাকালাম, মনে হলো কি এক মহা ঐশ্বর্যের সন্ধান পেয়ে হুজুর শান্তমনে শুয়ে আছেন, মাওলার দিদারে তাঁর হৃদয় যেনো আনন্দে ভরপুর হয়ে আছে, তাঁর চেহারায় সে খুশী উদ্ভাসিত।
বুরাইয়ার হুজুর!
অনেক পরে জেনেছি হুজুর উনার এলাকায় “ঘোড়াডুম্বুরী হুজুর” নামে পরিচিত।
তবে আমাদের কাছে তিনি বুরাইয়ার হুজুর।
‘বুরাইয়ার হুজুর’ এই সম্বোধনের মধ্যেই যেনো রমাদ্বানের ঘ্রাণ মিশ্রিত। আমাদের শৈশবকালে বুরাইয়ার হুজুরের ফুলতলীতে আগমন মানেই ছিলো রামাদ্বানের আগমনী বার্তা। আমার নিজের একান্ত অনুভূতির কথা বলছি – রামাদ্বান ছাড়া হুজুরের ফুলতলীতে আগমন ঘটলে রামাদ্বানের ই সুবাস পেতাম। এর কারণ হলো হুজুরের নামটি রামাদ্বানে দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট প্রধান কেন্দের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
তিনি নিরবে প্রায় ৩০ টি বৎসর কুরআনে কারীমের খেদমত করেছেন। কুরআন শরীফকে ভালোবেসেছেন, দারুল কিরাতকে ভালোবেসেছেন, তাঁর ছাত্রদের ভালোবেসেছেন।
এখনো যেনো চোখে ভাসছে রামাদ্বানে হুজুর রুটিন ডাকার পরে আস্তে আস্তে হেটে হেটে ক্লাসের দিকে যাচ্ছেন, কখনো রাস্তায় দেখা হয়ে গেলে আগেভাগে সালাম দিয়ে সেই দরদভরা স্নেহময় হাসি, সে হাসির রেষটুকু হুজুরের শেষ বিদায়ের দিনও চেহারায় দেখেছি… নির্মল স্নেহময় চেহারা।
এখনো কানে বাজে ইফতারের সময় হুজুরের ছাত্রদের প্রতি দিকনির্দেশনা-
প্রথমেই হুজুর ‘বিসমিল্লাহ’ বলার সাথে সাথে বণ্টনকারী খাবার বিতরণ শুরু করতেন, এরপরে হুজুর সময় সময় বলতেন- “ভাত পুকুরে ফেলবেন না”
“প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভাত-তরকারী নিবেন না ”
“অমুক লাইনে তরকারী নেই, অমুক লাইনে ডাল নেই” ইত্যাদি।
শেষের কয়েক বছর হুজুর শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে যাওয়ায় এ দায়িত্বে ছিলেন না তবে আজো সে আওয়াজ মধুর হয়ে কানে বাজে।
ছাত্ররা ভুল-বেয়াদবি করলে বিচার হতো, শাস্তির সময় আসলে একজন হুজুর দাঁড়িয়ে ছাত্ররা আর এমন করবে না বলে ছাত্রদের পক্ষ থেকে নিজে ক্ষমা চেয়ে ছাত্রদের শাস্তির হাত থেকে বাঁচিয়ে দিতেন.. তিনি ছিলেন আমাদের সবার প্রিয় বুরাইয়ার হুজুর, এমনটি অনেকবার ঘটেছে।
হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.) দারুল কিরাতের রুটিন সহ যাবতীয় ব্যাপারে খুব বেশী খেয়াল রাখতেন, ক্লাসের সময় রুটিন ডাকার পর ছাত্রদের বাইরে ঘোরাফেরা এমনকি শিক্ষকদের বাইরে থাকা অত্যন্ত অপছন্দ করতেন। রুটিনে কোনো সময় গণ্ডগোল লেগে গেলে রাগ করতেন, সেই সময় বাবা-চাচারা কেউ সামনে যেতেন না তখন বুরাইয়ার হুজুরকে সামনে দিয়ে দেওয়া হতো, তিনি গিয়ে দরাজ কন্ঠে বলতেন -“ছাব!”
ছাহেব কিবলাহ মুচকি হেসে দিতেন, তখন ছাহেবের রাগটাও চলে যেতো।
রামাদ্বানে ক্লাসের পরে হুজুর কে দেখা যেতো উনার রুমের সামনে বসে কুরআন তেলাওয়াত করছেন, রুমের সামনে বসার কারণ হলো বিদ্যুৎ চলে গেলেও যেনো তেলাওয়াতে বাধা না পড়ে। বাইরের চঞ্চল পৃথিবী, কখনো রোদ, কখনো বা বৃষ্টি, ছাত্রদের চলাফেরা, রাস্তা দিয়ে মানুষের যাতায়াত,বাইরের কোলাহল হুজুরের তেলাওয়াতে বিন্দু পরিমাণ প্রভাব ফেলতো না, তিনি একমনে তেলাওয়াত করে যেতেন, এই স্থানের সামন দিয়ে ঘন্টা কয়েক আগে গেলেও যে দৃশ্য দেখা যেতো, কয়েক ঘন্টা পরেও একি দৃশ্য।
হুজুর রামাদানে কত খতম কুরআন তিলাওয়াত করতেন আল্লাহ পাকই ভালো জানেন।
রামাদ্বানের চিরচেনা এ মধুর দৃশ্য আর কখনো দেখা যাবে না।
হুজুর দুনিয়ার হকীকত কে তাঁর কর্মের দ্বারা বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন -একসময় এমন একটি ক্ষণ আসবে যখন সবাই একটি ছোট্ট ঘরে মাওলার কাছে সোপর্দ করে চলে আসবে, বাইরে ঠিক ই কর্মচঞ্চল পৃথিবীর সকল কার্যক্রম চলবে.. কিন্তু যিনি চলে গেছেন তিনি একাকী, নিস্তব্ধ এক মাটির ঘরে। তাই ওলী আল্লাহগণ পৃথিবীতে কোলাহলের মাঝে থেকেও সেই একা ঘরের সামান জোগাড় করে রাখেন, দুনিয়ায় থাকতেই সেই ঘরকে আলোকিত করার ব্যবস্থা করে যান।
হুজুর নীরবে দ্বীনের তরে কাজ করে গেছেন, বুরাইয়া কামিল মাদরাসায় প্রায় ৪০ বছর শিক্ষকতা করে অসংখ্য ছাত্র গড়েছেন, অনেক খানকা পরিচালনা করেছেন, আশপাশের মানুষদের আল্লাহর পথে ডেকেছেন, সর্বোপরি তিনি সুদীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর কুরআনে কারীমের খেদমত করেছেন, আর রাসুলে পাক (সা.)’র এ ব্যাপার হাদীস হলো
-خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ اْلقُرْآنَ وَعَلَّمَه
হুজুর নীরবে দ্বীনের কাজ করে গেছেন কিন্ত তাঁর চলে যাওয়া সরব ছিলো, মানুষে মানুষে তাঁর কোমল আচরণের আলোচনা, আল্লাহর ওয়াস্তে মানুষদেরকে তাঁর ভালোবাসার কথা আলোচিত হয়েছে সর্বত। তাঁর চলে যাওয়ায় সবার চোখ ছিলো অশ্রু সজল, কিন্তু তাঁর চেহারাখানি ছিলো উজ্বল, আনন্দিত।
আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করে তাঁর কাজের উত্তম জাযা দিয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করে তাঁর দরজা বুলন্দ করে দিন। আমিন
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাউছার উদ্দিন সুমন
নির্বাহী সম্পাদক: আনিছুর রহমান পলাশ
বার্তা সম্পাদক: শহিদুল ইসলাম রেদুয়ান
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: নুরুল হক, শহিদ মিয়া