শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:২০ পূর্বাহ্ন

কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ ঢেঁকি,,হাওড় বার্তা

বি এম বাবলুর রহমান
  • সংবাদ প্রকাশ বৃহস্পতিবার, ৬ মে, ২০২১
  • ৬৩৭ বার পড়া হয়েছে

 

সাতক্ষীরা জেলা প্রতিনিধি 

“”” চাল আছে ঢেঁকি চাটা,রয়েছে পানের বাটা,

কলাপাতা ভরে দেবো, ঘরে পাতা দৈ

ঐ দেখ আছে মোর আয়নাটা কই “””

দেশের ঐতিহ্য এক সময়কার খাদ্য প্রস্তুত করা এক মাত্র নির্ভরযোগ্য বস্তূ ছিলো ঢেঁকি যা এখন কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে,

বিলিপ্তের পথে গ্রামীণ ঢেঁকি।

বাংলার গ্রামীণ রমনীরা ঢেঁকিতে ধান ভানা,হলুদ কোটা,মোটর সুটি,ডাউল কোটা,ও পৌষ পার্বণে পিঠা তৈরির জন্য চাউলের গুড়ো কোটার জন্য ব্যবহৃত সরল যন্ত্রবিশেষ,কথায় আছে না ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’ বাংলার এ প্রবাদ বাক্যটি বহুকাল ধরে প্রচলিত হলেও ঢেঁকি আর এখন ধান ভানে না। এই সরল যন্ত্রটি এখন আর গ্রাম বাংলায় দেখা যায়না বললেই চলে।

এক সময় গ্রাম বাংলায় ধান ভানার একমাত্র যন্ত্রই ছিল ঢেঁকি। প্রাচীনকাল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে ঢেঁকি ব্যবহার হয়ে আসছে। তখন বাংলার ঘরে ঘরে ধান ভানা,চিড়া কোটা, চাল ও চালের গুঁড়া করার জন্য ঢেঁকিই ছিল একমাত্র মাধ্যম। বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক ঢেঁকি গৃহস্থের সচ্ছলতা ও সুখ সমৃদ্ধির প্রতীক হিসাবে প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে এখন পুরোপুরি যান্ত্রিকতার (ঢেঁকি)বিলিন হয়ে গেছে। মাছে ভাতে বাঙালির ঘরে একসময় নবান্নের উৎসব হতো ঘটা করে। উৎসবের প্রতিপাদ্যটাই ছিল মাটির গন্ধ মাখা সূ-গন্ধী ধান। ঢেকি ছাঁটা ধানের চালের ভাত আর সুস্বাদু পিঠার আয়োজন। রাতের পর রাত জেগে শরীরটাকে ঘামে ভিজিয়ে ঢেঁকিতে ধান ভানার পর প্রাণ খোলা হাসি হাসত রমনীরা।

সেই ঢেঁকির এখন প্রস্থান ঘটেছে। কিন্তু কালের বিবর্তনে আর যান্ত্রিক সভ্যতার আগ্রাসনে অধুনিক এই যুগে গ্রাম বাংলার ঢেঁকি আজ বিলুপ্তির পথে। মূলত ৭০-এর দশকের পর ইঞ্জিন চালিত ধান ভাঙ্গা কল আমদানির পর গ্রাম অঞ্চল থেকে ঢেঁকির অবশন হওয়া শুরু হয়েছে। ক্রমান্বয়ে ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন গ্রামের মানুষ ভুলে গেছেন ঢেঁকি ছাঁটা চালের স্বাদ,আর তরুন প্রজন্ম তো চেনেই না এই যন্ত্রটি। যান্ত্রিক সভ্যতা গ্রাস করেছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী কাঠের ঢেঁকি শিল্পকে। ডিজিটাল যুগের আগামী দশকে তরুণ প্রজন্মরা ঢেঁকি কি তা চেনবেই না।

এক সময় ধান থেকে চাল তৈরির একমাত্র মাধ্যম ছিল ঢেঁকি। আর ঢেঁকি ছাঁটা চাল ছিল শরীর ও স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। গ্রামের মেয়েরা পালাক্রমে ঢেঁকিতে ধান থেকে চাল তৈরির সময় নানা গান-গীত পরিবেশন করত। যা কেবলই স্মৃতি। সব এলাকাতেই আধুনিক যুগে ঢেঁকির পরিবর্তে ধান ছাঁটাইসহ চালের গুঁড়া তৈরি হচ্ছে বিদ্যুৎচালিত মেশিনে। বর্তমান চাল ব্যবসায়ীরা বিদ্যুৎচালিত মেশিনে ধান ছাঁটাই করার পর ওই চালে ইউরিয়া সার দিয়ে পালিশ করে তা চকচকে করে বাজারজাত করছে বলে সবার মুখে মুখে প্রচালিত রয়েছে এবং সেটায় বাস্তব। ঢেঁকি ছাঁটা চালের ভাত শুধু লবণ দিয়ে খেতে ভালো লাগত তখন, আর যদি তাতে ভাতের মাড় থাকতো তাহলে কথাই ছিল না। আজকের দিনে ইউরিয়া মেশানো চালের ভাত খেতে খেতে ঢেঁকি ছাঁটাই চালের ভাতের স্বাদ একেবারে ভুলেই গেছি।

নবান্ন উৎসবঃ বাঙালির ঐতিহ্যবাহী, অসাম্প্রদায়িক ও মাটির সঙ্গে চির বন্ধনযুক্ত নবান্ন উৎসবের মাস। গ্রামে একসময় নতুন ধান ওঠাকে কেন্দ্র করে নবান্ন উৎসব হত। সেই উৎসবে পরিবারের শিশু-কিশোররা কত না আমোদ-আহলাদে ধেই ধেই করে নাচতো আর গাইতো। উহ্ ! সে কি আনন্দ ! ঢেঁকি চাঁটা চালের আটা হতে তৈরি হত নানা রকমারি বাহারী সাজের না না পিঠা ও সূ সাধু পায়েশ,বাড়ি বাড়ি পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যেত। নতুন-জামাইদের সে পিঠায় আপ্যায়ন করতে শাশুড়ীও শালা বৌরা প্রবাদে আছে ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। একসময় ঢেঁকির সুরেলা শব্দ সাতক্ষীরায় আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিলিপ্তে তুলত নবান্ন উৎসব,কবি রা লিখে গেছেন নানা কবিতা ” চাল আছে ঢেঁকি চাটা,রয়েছে পানের বাটা”” আর সেই কবিতা এখন শুধু ইতিহাস সকল সব কিছু এখন কল্প কাহিনী।

 

সকল হারানোর মাঝে আজ নবাগত কিছু ভাষার পরিবর্তন ঘটেছে,

ঢেঁকিতে ধান ভানা আজ বর্তমান যুগে রাইস মিলে ধান মাড়াই হয়েছে শব্দের উচ্চারণ কোনো কোনো স্থানে ডিজেলের মেশিন ছাড়াও ভ্যান গাড়িতে ভ্রাম্যমাণ ইঞ্জিন নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ধান ভানা ও মাড়াই করছে। যার কারণে গ্রামের অসহায় ও অভাবগ্রস্থ মহিলারা যারা ধান ভেঙে জীবিকা নির্বাহ করতো তারা বিকল পথ বেছে নেওয়া ছাড়া অনেকে ভিক্ষা করে দিন অতিবাহিত করছে বলে জানা গেছে।

কেউবা কাজ করছে অন্যের বাড়ির ধান শুকানোর কাজ,এ ছাড়া ঢেঁকি আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির এক অপূর্ব নিদর্শন। যখন যন্ত্রচালিত ধান ভানা কল ছিল না তখন ঢেঁকির কদর বেশ ছিল। আর তখনকার সময়ের মানুষের জন্য এই ঢেঁকি আবিষ্কার ছিল যথেষ্ট । এখন এধরনের ঢেঁকি আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে হাস্যকর বা অজানা থেকে যেতে পারে যাহা মাত্র সময়ের ব্যবধান। কারণ বর্তমানে ভিনদেশী চাকচিক্যময় সংস্কৃতি সমাজে আবির্ভাবে আমাদের পুরোনো সংস্কৃতি নিজস্ব ঐতিহ্যকে পশ্চাতে ফেলে যেন জ্যামিতিক হারে এগিয়ে চলছে। ঠিক আমাদের পুরোনো সংস্কৃতি গাণিতিক হারের মত দুর্বল হয়ে পড়ছে। তাই এই দুর্বলতাকে পাশ কাটিয়ে আমাদের সংস্কৃতিকে আমরাই লালন করতে হবে,তখন ইতিহাসের পাতায় পড়া ছাড়া বাস্তবে খুঁজে পাওয়া দুষ্প্রাপ্য হবে, নতুবা কোনো যাদুঘরের কোণে ঠাঁই করে নিবে নিজের অস্তিত্বটুকু নিয়ে, তখন হয়ত আমাদের নতুন প্রজন্ম এই ঐতিহ্য থেকে একবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।

হারিয়ে যাওয়া এই যান্ত্রিকের বিষয়ে সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় ভায়ড়া গ্রামের আইনজীবী সহকারী বাবু বসু ঘোষ এর সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন বলেনসময় গ্রামে এই ঢেঁকি ছিলো খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা খাদ্য প্রস্তুত কারি বস্তূ,আমি নিজে আমার মায়ের সাথে ধান ভানা,চালের গুঁড়া কোটায় সাহায্য করেছি,আধুনিক এই যুগে এখন আর এই ঢেঁকি দিয়ে ধান ভানা বা এটাকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়, দুই একটা যা আছে তা কয়েক বছরের মধ্যে হারিয়ে যাবে, নতুন প্রজন্ম কে চিনতে সরকারী বা বেসরকারীভাবে আমাদের হারানো ঐতিহ্যগুলো নিয়ে বিশেষ মেলার আয়োজন করলে বর্তমান প্রজন্ম এই হারানো ঐতিহ্যগুলো চিনতে পারবে এবং রক্ষায় এগিয়ে আসবে।

সর্বশেষ সংবাদ পেতে চোখ রাখুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সব ধরনের সংবাদ
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধনকৃত পত্রিকা। © All rights reserved © 2018-2024 Haworbarta.com
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD
jphostbd-2281